শুক্রবার, মার্চ ৩১, ২০২৩
হোমজেলাসরাইলের বিশ্বখ্যাত গ্রে-হাউন্ড কুকুর বিলুপ্তের পথে

সরাইলের বিশ্বখ্যাত গ্রে-হাউন্ড কুকুর বিলুপ্তের পথে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বিরল প্রজাতির গ্রে-হাউন্ড কুকুর বিশ্বব্যাপী নামকরা। এই কুকুর পালন সৌখিনতা ও আভিজাত্যের পরিচয় বহন করলেও তা লালন-পালন করা খুবই ব্যয় বহুল।

দেশের র‌্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃংখলা বাহিনী ডগ স্কোয়ার্ডে স্থান পেয়েছে সরাইলের এতিহ্যবাহি এই গ্রে-হাউন্ড কুকুর। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে বর্তমানে বিলুপ্তির পথে বিশ্বখ্যাত ও বিরল প্রজাতির এই কুকুর।

বর্তমানে উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কয়েকটি মুচি পরিবার খুবই কষ্ট করে বাণিজ্যিকভাবে বিরল প্রজাতির এই কুকুর পালন করে আসছে। প্রায়ই আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সরাইলে আসেন এই কুকুর কিনতে। এছাড়াও সৌখিন কুকুর প্রেমিসহ বিদেশীরাও এখান থেকে পছন্দের কুকুর কিনতে আসেন।

সরাইলের বিরল প্রজাতির এই গ্রে-হাউন্ড কুকুরের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। এই কুকুরের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও আগের মতো এখানে কুকুর পাওয়া যায়না। এই কুকুর পালন করতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয় বলে অনেকেই এখন আর কুকুর পালন করেন না। উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কয়েকটি মুচি পরিবারের লোকজন খুবই কষ্ট করে এতিহ্যবাহি এই কুকুর লালন-পালন করে আসছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাণিজ্যিকভাবে অনেকেই এই কুকুর লালন-পালন করতেন।

এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ২০/২৫ বছর আগেও উপজেলার বিভিন্ন বাড়িতে লোকজন শখ করে, আবার অনেকেই আভিজাত্যের অংশ হিসেবে এই কুকুর পালন করতেন। কিন্তু কালের গর্ভে এসব এখন স্মৃতি, এসব এখন অতীত।

গ্রে-হাউন্ড কুকুর দেখতে অন্যান্য কুকুরের চেয়ে অনেক আলাদা। হিংস্রতাও বেশি। এই কুকুরের মুখমন্ডল অনেকটা শেয়ালের মতো, এই কুকুরের শরীর তিন থেকে চার ফুট লম্বা। কান ও মুখ বেশ লম্বাটে। পেট ছোট হলেও বুকটা চওড়া। লেজটা চিকন ও লম্বা। লেজ অধিকাংশ সময় দেহের নিচের দিকে সোজা ঝুলে থাকে। খুব একটা বাঁকা করেনা। হালকা-পাতলা গড়নের এই কুকরের পা ও পায়ের নখ লম্বা। বাদামি রঙের চোখ দুটি বড় বড়।

শুধু আকৃতি বা দৈহিক গঠনের দিক থেকে গ্রে-হাউন্ড অন্যান্য কুকুরের চেয়ে আলাদা তা কিন্তু নয়। আচরণের দিক থেকেও এরা আলাদা। হাঁটাচলা বা দৌড় দেয়ার ভঙ্গিটাও ভিন্ন। শুধু ঘ্রাণশক্তি নয়, দৃষ্টি ও শ্রবনশক্তির মাধ্যমে শিকার ধরা এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্রুতগামী এই কুকুর অন্যান্য কুকুরের মতো আদর প্রিয় হলেও অপরিচিতদের মানুষের আদর তাদের পছন্দ নয়। রাতের বেলা তাদের ঘেউ ঘেউ ডাকে মালিকের বাড়িতে কোন অপরিচিত লোক আসতে পারে না। প্রভুভক্ত শান্ত এই কুকুর শত্রুর কাছে খুবই ভয়ংকর ও হিংস্র। মালিকের বাড়ির নিরাপত্তায় এই কুকুরের জুড়ি মেলা ভার।

আরাম প্রিয় এই কুকুর অল্প পরিমানে খাবার খেলেও তাদেরকে উন্নত মানের খাবার দিতে হয়। দুধ-ভাত আর মাছ-মাংসই এদের প্রধান খাবার। সাদা, কালো, লালচেসহ বিভিন্ন ধরনের রঙ হয়ে থাকে এসব কুকুরের। স্বভাবে হিংস্র হওয়ায় এদেরকে শিকারের কাজে ব্যবহার করা হয়।

শিয়াল, বন বিড়াল, বাঘদাস শিকারে এরা খুবই পারদর্শী। চোর-ডাকাতরা এই কুকুরের নাম শুনলেই আতকে উঠে। তাই এসব গ্রে-হাউন্ড কুকুরের দামও একটু বেশি। বাচ্চা কুকুর প্রকার ভেদে প্রায় ৩০/৪০ হাজার আর বড় কুকুর ৬০/৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

সরাইল উপজেলার পানিশ্বর গ্রামের জালাল মিয়া জানান, শুনেছি আগে শীতকালে গ্রে-হাউন্ড কুকুর দিয়ে বন-জঙ্গল ঘেরাও করে ছোট বাঘ, গাছি খাটাশ, শিয়াল, বাগডাস, বন খাটাশ, বনবিড়াল ইত্যাদি বন্য প্রাণী শিকার করা হতো। এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রতিবছর সরাইলে গ্রে-হাউন্ড কুকুরের প্রদর্শনীও করা হতো। তাতে কুকুরের গুনগত মান যাচাই করে কুকুরের মালিকদেরকে পুরষ্কার দেয়া হতো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সৌখিন ব্যক্তিরা গ্রে-হাউন্ড কুকুরের বাচ্চা কেনার জন্য সরাইলে আসতেন।

তিনি বলেন, সারা বিশ্বে এই কুকুরের কদর বাড়লেও এর উৎপত্তিস্থল সরাইলে এই কুকুর এখন বিলুপ্তির পথে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সরাইলের নোয়াগাঁও গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে এই কুকুর পালন করা হচ্ছে। তিনি বিরল প্রজাতির এই কুকুরকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য দাবি জানান।

তবে কিভাবে এই কুকুর সরাইলে আসে তার সঠিক ইতিহাস কেউ জানে না। এলাকায় বিরল প্রজাতির এই কুকুরের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা কথা প্রচলিত আছে।

সরাইলের গ্রে-হাউন্ড কুকুর নিয়ে বেশ কিছু জনশ্রুত আছে। কথিত আছে, বহুকাল আগে সরাইলের জমিদার দেওয়ান হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক ইংরেজ সাহেবের কাছে তিনি সুন্দর একটি (মাদি-স্ত্রী) কুকুর দেখতে পান। জমিদার কুকুরটি কেনার জন্য ইংরেজ সাহেবের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ইংরেজ সাহেব কুকুরটি বিক্রি করতে রাজী হননি। পরে জমিদার একটি হাতির বিনিময়ে ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে কুকুরটি নিয়ে আসেন।

বাড়িতে আসার পরে জমিদার দেওয়ান একদিন কুকুরটি নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে বনে শিকারে বের হন। একপর্যায়ে কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর কুকুরটি গর্ভবতী হয়ে জমিদার বাড়িতে ফিরে আসে। কদিন পরই কুকুরটি কয়েকটি বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু বাচ্চাগুলো ছিলো সাধারণ কুকুরের বাচ্চার চেয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন আকৃতির। বাঘের বাচ্চার সাথে এই বাচ্চাগুলোর ছিলো বেশ মিল।

ধারণা করা হয় মাদি কুকুরটি বনে হারিয়ে যাওয়ার পর নেকড়ের সাথে কুকুরটির মিলন হয়েছিলো।

এই কুকুরের উৎপত্তি সম্পর্কে উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের গ্রে-হাউন্ড কুকুর পালনকারী তপন লাল রবি দাস বলেন, ঠাকুরদার মুখে শুনেছি বহুকাল আগে সরাইলের এক জমিদার (দেওয়ান) তার হাতি নিয়ে সরাইল পরগনা থেকে ভারতের কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি এক বাড়িতে বিরল প্রজাতির একটি (মাদি কুকুর) কুকুর দেখতে পান। জমিদার অনেক বলার পরও মালিক কুকুরটিকে বিক্রি করতে রাজী না হওয়ার পর জমিদার একটি হাতির বিনিময়ে মালিকের কাছ থেকে কুকুরটি নিয়ে আসেন। বাড়িতে আসার পরে জমিদার দেওয়ান একদিন কুকুরটি নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে বনে শিকারে বের হন। একপর্যায়ে কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর কুকুরটি গর্ভবতী হয়ে জমিদার বাড়িতে ফিরে আসে। কদিন পরই কুকুরটি কয়েকটি বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু বাচ্চাগুলো ছিলো সাধারণ কুকুরের বাচ্চার চেয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন আকৃতির। বাঘের বাচ্চার সাথে এই বাচ্চাগুলোর ছিলো বেশ মিল। তিনি বলেন, বনে হারিয়ে যাওয়ার পর বাঘের সাথে কুকুরটির মিলনের ফলেই বিরল প্রজাতির কুকুরের বাচ্চা জন্ম হয়।

তপন লাল রবি দাস বলেন, সেই কুকুর এক সময় কয়েক হাত বদল হয়ে তার দাদা গঙ্গাচরণ রবিদাসের কাছে চলে আসে।

বিরল প্রজাতির এই কুকুরের উৎপত্তি সম্পর্কে একই এলাকার জিতু লাল দাস বলেন, দাদার কাছে শুনেছি সরাইলের দেওয়ান একবার হাতি নিয়ে শিকারের জন্য বনে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলো তার প্রিয় মাদি কুকুরটিও। এক পর্যায়ে কুকুরটি হারিয়ে যায়। পরে বনে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি দেখতে পান বনে একটি নেকড়ের সাথে কুকুরটি মিলন করছে। বাঘের সাথে মিলনের ফলেই বিরল প্রজাতির এই গ্রে-হাউন্ড কুকুরের জন্ম হয়েছে।

সরজমিনে কুকুর পালনকারী উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের তপন লাল রবি দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় কুকুর পালনের জন্য বড় বড় বেশ কয়েকটি খাচা। কুকুর পালনের বিভিন্ন উপকরণ।

তপন লাল রবি দাস বলেন, টাইগার, মধু, পপি, কালী, লালী, টমি, কালাসহ বিভিন্ন নামে কুকুরের নাম রাখা হয়। জন্মের পর তাদের আচরণ অনুযায়ী নাম রাখা হয়। জন্মের পরে যে নাম রাখা হয়, সে নাম ধরে ডাকলেই কুকুরগুলো সামনে চলে আসে।

তিনি বলেন, বর্তমানে তার বাড়িতে ৩টি মাদি কুকুর ও ৫টি বাচ্চা কুকুর আছে। কিন্তু মাদি কুকুরগুলোর প্রজনন সমস্যার কারণে চিকিৎসার জন্য অনত্র স্থানান্তর করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ৫টি ছোট বাচ্চার জন্য প্রতিদিন ২ লিটার দুধ কিনতে হয়। তাছাড়াও এদেরকে মাংস ও মাছ খাওয়ানো হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, নিজের সংসার চালাতেই হিমসিম খাই। কুকুর পালন করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, যে ঘরে আমরা রাতে ঘুমাই, সে ঘরেই রাতে কুকুরগুলোকে রাখি। প্রায়ই চোরেরা আসে কুকুরের বাচ্চাগুলো নিয়ে যেতে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকার যদি আমাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা কোন সংস্থা যদি আমাদেরকে স্বল্প সুদে ঋণ দিতেন তাহলে আমরা বাণিজ্যিকভাবে কুকুর লালন-পালন করে লাভবান হতে পারতাম নতুবা এক সময় বাণিজ্যিকভাবে কুকুর পালন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, দাদা ও বাবার কাছে শুনেছি বৃটিশ আমলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার দাদা গঙ্গাচরণ রবিদাসকে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা করেছিলেন। তিনি ছাড়া কুকুর লালন-পালন করতে কেউ আমাদেরকে কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করেনি।

এ ব্যাপারে সরাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আরিফুল হক মৃদুল বলেন, সরাইলের ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে বিখ্যাত গ্রে-হাউন্ড কুকুরকে বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশ বিদেশে এই কুকুর সরাইলের পরিচিতি বহন করে। প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে সরাইলে এই কুকুরের একটি প্রজনন কেন্দ্র করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments