শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
হোমজাতীয়বামেদের অভিমত: সরকারের ভুল নীতির কারণেই হেফাজত শক্তি সঞ্চয় করেছে

বামেদের অভিমত: সরকারের ভুল নীতির কারণেই হেফাজত শক্তি সঞ্চয় করেছে

গণ শক্তি ডেস্ক: হেফাজতে ইসলামের মাথা চাড়া দেওয়া ও ইদানিং ঘটে যাওয়া  তাণ্ডবের পেছনে সরকারের ‘আপসকামিতা’ ও ‘প্রশ্রয়দানকেই’ দায়ী করছে দেশের বামপন্থি দলগুলো। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে কঠোর হস্তে দমনের বদলে ‘তোষামোদ’, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের সঙ্গে ‘সখ্যতা’ গড়ে তোলার সরকারের ভুল নীতির কারণেই এরা শক্তি সঞ্চয় এবং ধর্মের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার সাহস পাচ্ছে বলেও বলছে দলগুলো।

দেশে সক্রিয় বামপন্থি জোট ও দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে বেশিরভাগই হেফাজতে ইসলাম প্রশ্নে অভিন্ন মতামতই দিয়েছেন। বর্তমানে হেফাজতের বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নিলেও এ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন এসব দলের নেতারা। তারা বলছেন, এই পদক্ষেপও লোক দেখানো এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের আপসের পথে হাঁটার পুরোনো খেলারই অংশ। তা না হলে সরকার পুরোনো ও ছোটখাটো মামলায় না জড়িয়ে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের এবং কঠোর শাস্তির পদক্ষেপই নিত।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বাম দলগুলোও বলছে, সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে এখন যে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে, সেটা আরও আগেই দেখানো উচিত ছিল। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ব্যাপক নৈরাজ্য ও জ্বালাও-পোড়াও চালানোর পরপরই এদের শক্ত হাতে দমন করা উচিত ছিল। তা না করে সরকার এক ধরনের আপসের নীতি নিয়ে চলেছে। ফলে এরা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে দেশজুড়ে তাণ্ডবের পাশাপাশি সংবিধান, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার মতো ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহসও পেয়েছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় নেমে সারাদেশে তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলাম। বিশেষ করে ২৬ থেকে ২৮ মার্চ ধর্মভিত্তিক এই সংগঠনের কর্মীরা ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় জড়ায়।

বামপন্থি দলের কয়েকজন নেতা বলেছেন, হেফাজত নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতার নামে প্রথম থেকেই সহিংসতার পথে হেঁটেছে। ওই ঘটনার মাস কয়েক আগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতার নামেও তারা দেশজুড়ে অরাজকতা, বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন মনীষীর ভাস্কর্য ভাঙচুর ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনের ওপর হামলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কাজেই সরকার শুরু থেকেই এদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিলে তারা সম্প্রতি এমন তাণ্ডবের পথে যাওয়ার সুযোগ পেত না।

২০১০ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম থেকে পরিচালিত হয় সংগঠনটি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে প্রথম সবার নজরে আসে। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান করে গোটা এলাকায় নজিরবিহীন অরাজকতা ও জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সংগঠনটি।

এরপর নারী নীতির প্রকাশ্য বিরোধিতার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক থেকে কয়েকজন লেখকের লেখা বাদ দেওয়া এবং সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত ভাস্কর্যের অপসারণ আন্দোলন করেও দেশজুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন হেফাজত ও এর নেতারা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতায় নেমে আরেক দফা আলোচনায় আসেন মামুনুল হকসহ হেফাজতে ইসলাম নেতারা।

বাম নেতারা বলছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের নজিরবিহীন অরাজকতার পরপরই এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। তা না করে সরকারকে এই অপশক্তির সঙ্গে অনেকটা সমঝোতা কিংবা আপসের পথে হাঁটতে দেখা গেছে। ওই ঘটনার পরপরই হেফাজতের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন এবং সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্য অপসারণের মতো সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে।

১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, এটা ঠিক যে এই মুহূর্তে সরকার কিছু কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে হেফাজত ও এর নেতাদের দমন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেটা কতটা কঠোর সেটাও দেখার বিষয়। বাইরে থেকে যেটা মনে হচ্ছে, সরকার যেন পরিস্থিতিকে কেবল নিজেদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখতেই এক ধরনের কৌশল নিয়ে চলছে। যেটা সরকার নিজেও আগেই বলেছে, ‘সরকার চালাতে গেলে কিছু কৌশল নিতে হয়।’ কিন্তু কেবল কিছু ‘পুরোনো মামলা’ দিয়ে হেফাজতের মতো এত বড় একটা অপশক্তিকে চাপিয়ে রাখার সরকারের এই কৌশল যে খুব বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে, সেটাও মনে হয় না।

তিনি বলেন, হেফাজত তার নীতি থেকে একচুলও নড়েনি। বিশেষ করে তাদের মূল নেতা বাবুনগরী এখনও স্পষ্টভাবেই তাদের কথা বলে চলেছেন। এখনও ইউটিউবে আলেম-ওলামাদের নাম করে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের পক্ষ নিয়ে যেভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হবে কেবল যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও লেখালেখি করেন, তাদের বিরুদ্ধে। যারা ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে তাণ্ডব ঘটাবেন, তাদের পুরোনো মামলায় জড়িয়ে লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটা তো হতে পারে না।

রাশেদ খান মেনন বলেন, আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি- সরকার হেফাজতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রশ্নে যে আপসকামিতা ও সখ্য নীতি নিয়ে চলছে, সেটা সরকারের জন্যই বুমেরাং হবে। এই বুমেরাং আগেও হয়েছে, এবারও হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে মনে হলেও সরকার পুরোনো প্যাটার্নেই চলছে। আসলে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিয়ে লুটেরা ধনিক ও বুর্জোয়া শক্তির প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির টানাটানি চলে। সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী দেশগুলোর সেবা কে ভালো করতে পারে, এটা নিয়েও তাদের পরস্পরের প্রতিযোগিতা চলে। সেই খেলাই সম্ভবত আমরা দেখছি।

তিনি বলেন, হেফাজতের সঙ্গে অতীতের আপসকামিতার ভুল নীতি থেকে আওয়ামী লীগ ও সরকারের কোনো শিক্ষা হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে এখনই বলা যাবে না। দেখতে হবে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কতটা কঠোর হতে পারে। এখন পর্যন্ত যেটা হয়েছে, সেটা তাদের পুরোনো খেলারই অংশ। তা না হলে যেসব অভিযোগ করে হেফাজত নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটা না করে অভিযোগগুলোকে আরও সরাসরি করে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার সুযোগ ছিল বা আছে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত একই সূত্রে গাঁথা। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দমনে কোনো আপস নয়। দুধকলা দিয়ে সাপ পুষলে তার ফল কখনও শুভ হয় না। তিনি বলেন, হেফাজতি মোল্লারা হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সংবিধান ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকারকারী। কাজেই হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা-নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের অভিযোগে করা মামলার সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের, দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো এদের দমন করা যাবে না।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments